নদীকাহিনী
নদীকাহিনি
-ব্রতী মুখোপাধ্যায়
নদীর মুখে কথা নেই।
তা একদিন দিন কখন ফুরিয়ে এসেছে, নদীর দিকেই এল এক হলুদকালো বাঘ উত্তর দিক থেকে। পরে পরেই দক্ষিণ দিক থেকে এল এক মায়ানয়ন হরিণ।
সেই বাঘ এল পাখির পালক, মাছের কাঁটা, শেয়াল-কুকুরের হাড় আর মানুষের করোটি ও কঙ্কাল মাড়িয়ে মাড়িয়ে।
সেই হরিণ এল প্রতিমাট্রতিমার বাঁশের টুকরো, কাচ, টিন, প্লাস্টিকের বোতল আর পাথরটাথর মাড়িয়ে মাড়িয়ে।
বাঘ আর হরিণ, হরিণ আর বাঘ, দুজনেই জলের খোঁজ করছিল। জলের খোঁজ করছিল আর পরস্পরকে জরিপ করছিল। বাঘ দেখল হরিণের কী চেহারা হয়েছে! হাড়সর্বস্ব, একছটাক মাংস নেই কোথাও। দেখল মনোমোহন চোখের নিচ দিয়ে গাল বেয়ে শুকিয়ে যাওয়া কান্নাজলের ছাপ। হরিণও দেখল বাঘকে বাঘ বলে মনে হচ্ছে না। কে জানে কত দিন না খেয়ে আছে। দেখল গায়ের ওই উজ্জ্বল হলুদকালো ডোরা কিরম ম্যাড়ম্যাড়ে, চোখদুটো ঘোলাটে, আর গাগতরে পোড়া যন্ত্রণারা।
আকাশে চড়া রোদ এইসময় নেই। এইসময় চাঁপা আলো পশ্চিমপাহাড়ের মাথার ওপর থেকে নিশ্যাম মাঠ পেরিয়ে নদী অব্দি। অন্ধকার নামছে নামছে। এখন আছে বলতে দিনের রোদ, দিনের রোদ, আর রাতের অন্ধকার। পর্যাপ্তই আছে।
জলের খোঁজ করতে করতেই বাঘ আর হরিণ হঠাৎ কখন কাছাকাছি, হঠাৎ কখন গায়ে গায়ে। যেতে যেতে হরিণ একবার থামল। থেমে বাঘকে ডেকে আদরকণ্ঠে বলল--- এই যে বাঘ, আমার কথা শোনো!
বাঘেরও চলছিল না পা। থামল সে। বলল--- বলো।
হরিণ বলল--- দেখো বাঘ, আমি আর কিছুতেই বাঁচব না।
বাঘ বলল--- আমিও।
হরিণ বাঘের মুখের কাছে এগিয়ে এল। বলল--- তুমি এক কাজ কর। আমাকে না খেয়ে ফেলো।
হরিণকে দেখছিল বাঘ, অবাক বিষাদ তার চোখে ঝুলছে।
হরিণ আবার মুখ খুলল--- তিন সীমানায় গরু ছাগল হাঁস হরিণ কিচ্ছুটি নেই। তোমার খুবই খিদে পেয়েছে। খাবে কি? আমাকে খাও। দুদিন তাও বাঁচবে। হাজার হলেও বাঁচাটাই বড়।
বাঘের তখন কাঁদোকাঁদো গলা--- তুমি?
হরিণ বলল--- আমার কথা ছাড়ো। ঘাসের চিহ্ন নেই, লতাপাতাও নেই। নাও, এবার খাও তো।
বাঘ এবার কেঁদে ফেলল--- সে নাহয় হল। তুমি বেঁচে গেলে। আমাকে কে খাবে?
নদী মরতে মরতে এই দৃশ্য দেখতে পেয়েছিল। জল ছিল না, কাঁদবে যে একটুও জল ছিল না চোখে।
No comments