Header Ads

তাবিজ


শামিম মনোয়ার:
দু'জন  বসে আছে নদীর দিকে মুখ করে। নদীর সেই রূপ আর এখন নেই। শীত পড়ে গেছে নদীর জলও তলানীর দিকে চলে আসছে। ওপারে ধু ধু বালিচর।  এপারে শহর রক্ষা বাঁধ। বর্ষা মৌসুমে নদীর প্রবল স্রোতের ভাঙ্গন থেকে শহর রক্ষার জন্য বাঁধটি দেওয়া হয়েছে। বাঁধের একটা অংশ টি অক্ষরের লেজের মতো নদীর ভিতরের দিকে চলে গেছে। দু দিকে জলের নিচ থেকে উপর পর্যন্ত পাথর ফেলা।  বিকেলের দিকে এ শহরের প্রচুর নারী পুরুষ এ বাঁধটিতে বেড়াতে আসে। পাথরের উপর বসে থেকে ছিপ ফেলে অনেকে মাছ ধরে।  কোন বড়শীতে একটা মাছ অাটকালে সবাই হৈ হৈ করে দেখতে যায়। নদী তীরটি সরগরম হয়ে উঠে।
নিলুফার ও মিরাজ একটু দুরেই জলের কাছাকাছি পাথরের উপর বসে আছে। এ দিকটায় মানুষ জন কম।  শীতে নদীর জল স্বচ্ছ হয়। মিরাজ জলের দিকে তাকিয়ে আছে।  নিলুফারের চোখ দুরে ওপারের বালির চরের দিকে। বিকেলের রোদ বালির উপর পড়ে চিক চিক করছে।  জলের উপর দিয়ে বকের সারি উড়ে যায়।  নীল আকাশ, শাদা শাদা মেঘ। জলে তার ছায়া পড়ে আছে।

নিলুফার বললো-আমাকে এখানে কেনো নিয়ে এসেছো?
মিরাজ বললো তোমাকে আজকে তাবিজের গল্পটা বলবো।
নিলুফার মিরাজের দিকে তাকালো। কী কোমল শান্ত মুখ!  চোখে মায়াবী ছায়া।  মিরাজ মুগ্ধ হয়ে গেলো।  সে কোন দিন তার বিবাহিত স্ত্রীকে এত মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে দেখেনি।

বিয়ের পর থেকেই নিলুফার মিরাজের গলায় কালো সুতা দিয়ে বাঁধা বড় ধরনের চৌকোনো রূপার তাবিজটা দেখে আসছে। মিরাজদের পরিবারে সবাই শিক্ষিত অাধুনিক।  তাহলে মিরাজের গলায় তাবিজ কেনো?  তার কি  অসুখ বিসুখ  বা কোন কুসংস্কার। একদিন সে এ ব্যাপারে মিরাজকে বলেছিলো।  সে কোন উত্তর দেয় নি।  এমনিতে মিরাজ তার সাথে তেমন কথা বলে না।  রাত করে বাড়ি ফিরে, দেরি করে ঘুম থেকে উঠে বাইরে বেড়িয়ে যায়। কোথায় যায় বলে না। তবে বাবার বিশাল ধান চালের আড়ৎ আছে সেখানে নাকি মাঝে মাঝে বসে। সে নাকি নেশা টেশাও করে। এ ব্যাপারে নিলুফারের কোন কথাই চলে না।  সে কোন অভিযোগও করে না। গরীব বাবার মেয়ে। বড় লোকের ছেলের সাথে বিয়ে। এতেই সে সুখী। অনেক গুলো ভাইবোনের পরিবারের মেয়েকে বাবার মুখের দিকে তাকাতে হয়।

মিরাজ কোনদিন  বিয়ে করতে চায়নি। সে ভালোবাসতো টুম্পা নামের একটা মেয়েকে।  মিরাজের অন্যান্য ভাইবোন বেশ শিক্ষিত কিন্তু মিরাজেরই বেশি লেখাপড়া হলো না।  সে কলেজে যেতে না যেতেই প্রেমে পড়ে সব কিছু  এলোমেলো করে ফেললো। টুম্পার বিয়ে হয়ে গেলো। মিরাজ ধীরে ধীরে অন্ধকার জগতে চলে গেলো। আত্মীয় স্বজন মিরাজের বাবাকে বুদ্ধি দিল ছেলেকে বিয়ে করিয়ে দিন ঠিক হয়ে যাবে। কিছুটা চেনা জানার মধ্যে গরীব ঘরের মেয়ে নিলুফারের  সাথে বিয়ে হলো মিরাজের।  মিরাজ নিলুফারকে স্ত্রী হিসাবে তেমন মেনে নিল না তবে পরিবারের মতামতের বিরুদ্ধে কোন কথাও বলতে পারলো না। তার অন্ধকার জগত তার সাথে রয়ে গেলো।
তবে একটা বিষয় সে আজকাল লক্ষ্য করছে, সে বদলে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। টুম্পার সাথে তার প্রেম ছিলো যে কয় বছর তার অর্ধেকের বেশি ছিলো ঝগড়া বিবাদ। সারাক্ষন টুম্পার অভিযোগ সন্দেহ। এই সাথে আছে এই নাই। এই সব কিছু বাদ এই আবার শুরু। টুম্পাকে সে ভুলতে পারে না আবার তার দেওয়া কষ্টে সে রাত জাগে, এটা সেটা খায়। বড় কষ্ট আবার বড় আনন্দও ছিলো টুম্পা।

নিলুফার পুরোপুরি অন্য রকম।  নিলুফারের দায়িত্ববোধে মিরাজ বুঝতে পারে এটাই বুঝি ভালোবাসা। ঘুম থেকে উঠে সে খাট থেকে নামতেই দেখে ঘরে পড়ার স্যান্ডেলটিও ঘুরিয়ে সোজা করে রাখা। মুগ্ধতা দিয়ে তার দিন শুরু হয়। এ ভাবে সারাদিন রাত যতটুকু সে বাড়িতে থাকে ততটুকু সে নিলুফারের যত্নের ছোঁয়া পায়।

সে কোনদিন নিলুফারকে নিয়ে কোথাও ঘুরতে বেড়াতে যায় নি।  হঠাৎ আজকে সে তাকে যমুনা নদীর তীরে ক্লোজারে বেড়াতে নিয়ে এসেছে।

মিরাজ গলা থেকে তাবিজটা খুলে ফেলে। নিলুফার অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে।
একটা কাঠি দিয়ে তাবিজের মুখটি খুঁচিয়ে একটা কাগজ বের করে আনে। নিলুফারের দিকে তাকিয়ে বলে - টুম্পা নামের একটা মেয়েকে ভালোবাসতাম। সে আমাকে রক্ত দিয়ে একটা চিঠি লিখেছিল। সেই চিঠিটি আমি তাবিজ করে এতদিন গলায় ঝুলিয়ে রেখেছি। বলতে বলতে সে কাগজটির ভাজ খুলে ফেলে।  নিলুফার দেখে সেখানে বিবর্ণ লাল অক্ষরে লেখা - মিরাজ আমি তোমাকে ভালোবাসি- টুম্পা।

মিরাজ কাগজটি আবার তাবিজের মধ্যে ঢুকিয়ে ঢিল ছুঁড়ে নদীর মধ্যে ফেলে দেয়। দুজনের চোখের সামনে সুতো সহ তাবিজটি পাক খেতে খেতে জলের ভিতর তলিয়ে যায়।

নিলুফার অবাক হয়ে বলে, আহা! একি করলে, তোমার তাবিজ!
মিরাজ নিলুফারের হাত দুটো ধরে দাড়িয়ে বলে - এখন থেকে আমার তাবিজ তো তুমি।

অস্তমিত সূর্যের আলোতে মুখোমুখি দাড়িয়ে থাকা এক জোড়া নারী-পুরুষকে দুর থেকে ক্যালেন্ডারের কোন ছবির মত মনে হয়।

No comments

Powered by Blogger.